নভেম্বরেও ডেঙ্গুর ভয়াবহতা: ৮ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৭৭৮
নিজস্ব প্রতিবেদক
নভেম্বর ২৮, ২০২৫, ০৫:২৪
বাংলাদেশে মৌসুমি পরিবর্তনের শেষভাগে এসে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে এমন প্রত্যাশা থাকলেও নভেম্বরেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও আট ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছেন। একই সময়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৭৮ জন রোগী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্তের মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার ২৬৪ জনে। বছরজুড়ে এ রোগে এখন পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৬৪ জন। অস্বাভাবিক মৌসুমি বৃষ্টিপাত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, নগর এলাকায় অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সব মিলিয়ে নভেম্বরেও ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ডেঙ্গুর ইতিহাসে ২০২৩ সাল ছিল সর্বাধিক প্রাণঘাতী। সে বছর আক্রান্ত হন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন, আর মৃত্যুবরণ করেন ১ হাজার ৭০৫ জন। ২০২৪ সালে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসে ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জনে, এবং মোট মৃত্যু হয় ৫৭৫ জনের। ২০২৫ সালে আক্রান্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হলেও মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক অবস্থানে রয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ২০২৫ সালের আক্রান্তের হার ধীরে ধীরে বেড়েছে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত, কিন্তু নভেম্বরেও যে এভাবে মৃত্যু অব্যাহত থাকবে তা তারা প্রত্যাশা করেননি। কারণ শীতের শুরুতে সাধারণত এডিস মশার সক্রিয়তা কমে যায়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও শহরাঞ্চলে অগোছালো পরিস্থিতি সেই চক্রকে ভেঙে দিচ্ছে।
রাজধানী ঢাকা সব সময়ের মতোই আক্রান্তের শীর্ষে থাকলেও এ বছর ময়মনসিংহ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, চট্টগ্রাম এসব জেলাতেও রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীর চাপ এতটাই বেড়েছে যে নতুন রোগীদের জন্য শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাড়িঘর ও দোকানপাটের পেছনে জমে থাকা বর্জ্য, নির্মাণাধীন স্থাপনা এবং গৃহস্থালির ছোট পাত্রে জমে থাকা পানি থেকেই মূলত বিস্তার ঘটছে এডিস মশার। নগর ও উপশহর এলাকায় বাড়তি জনঘনত্ব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত হয়েছে দীর্ঘ সময়জুড়ে। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাত হয়েছে, ফলে এডিস মশার প্রজননকাল স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দীর্ঘ হয়েছে। এডিস মশা সাধারণত ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বেশি সক্রিয় থাকে, যা নভেম্বরে বেশিরভাগ অঞ্চলে বজায় ছিল।
জলবায়ুবিদরা আরও বলছেন, শহুরে উষ্ণতা (urban heat island effect) এডিস মশার বেঁচে থাকার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করছে। একই সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং বহুতল ভবনের ছাদে পানি জমে থাকার প্রবণতা ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়িয়েছে।
হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর চাপ এ বছরও স্বাভাবিক পর্যায়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। চিকিৎসক ও নার্সদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোগীর সেবায় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। দেশের কিছু হাসপাতালে প্লেটলেটের চাহিদাও বেড়েছে। এখনো পর্যন্ত বেশির ভাগ রোগীই সাধারণ ওয়ার্ডে চিকিৎসা পেলেও গুরুতর অবস্থার রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে আইসিইউর ওপর চাপ আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়া এবং দেরিতে হাসপাতালে আসাই মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট, রক্তক্ষরণ, প্লাজমা লিকেজ এই জটিলতাগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা না পেলে রোগীর অবস্থা দ্রুত অবনতি ঘটে।
যদিও ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিভিন্ন প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে, তারপরও অনেক এলাকায় মানুষ নিয়মিত বাসাবাড়ি পরিষ্কার রাখার বিষয়ে উদাসীন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো উৎসস্থল ধ্বংস করা। একটি বাড়ির ভেতরে এবং বাইরে ১০ মিনিট চেষ্টা দিলেই এডিসের সম্ভাব্য প্রজননস্থল পরিষ্কার রাখা সম্ভব।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি জরুরি করণীয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন- ঘরে-বাইরে পানি জমে থাকতে না দেওয়া, সাপ্তাহিক বাড়ি পরিষ্কারের অভ্যাস গড়ে তোলা, জ্বর হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রক্ত পরীক্ষা করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রশাসনকে আরও কঠোর হওয়া নগরগুলোতে সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা।
নভেম্বরে এসে ডেঙ্গুর এমন প্রাদুর্ভাব দেখিয়ে দেয়, বাংলাদেশে এ রোগ এখন আর মৌসুমি নেই বরং সারা বছরব্যাপী নজরদারি ও সচেতনতা প্রয়োজন। আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কমলেও, মৃত্যুর হার যে উচ্চ অবস্থানে থেকে যাচ্ছে তা একটি বড় সতর্কবার্তা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী বছর পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আগেই এখনই সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
আমার সংবাদের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন